স্বপ্নপূরণের আশায় আলিসা
ছোট ছোট সোলা বা থার্মোফ্লাস্ক বা শালপাতার বাটি, থালা, সুন্দর ভাবে ডিজাইন করে তা পোশাকের উপর প্রয়োগ করে এক অভিনব শিল্পসত্তার পরিচয় দিয়েছে আলিসা। কোন ডিগ্রীধারী ফ্যাশন ডিজাইনার নয়। শখ, ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার। আর এথেকেই একের পর এক অভিনব ডিজাইন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে আলিসা। সে মেয়েদের পোশাক হোক বা ছেলেদের পায়জামা পাঞ্জাবী হোক। শিল্পীর ছোঁয়ায় এক নতুন মাত্রা পাচ্ছে এইসব।
হঠাৎ করেই যে সে এটা করছে তা নয়। আলিসার বাবার নেকাব তৈরীর হোলসেল ব্যবসা। মূলতঃ বলা যায় এটা পারিবারিক ব্যবসা। মা-বাবা র হাত ধরেই শেখা কাটিং, স্টিচিং। ছোটবেলা থেকেই দেখত বাবা কিভাবে তৈরি করছে নেকাব। বাবার হাতের কারুকার্যে একটা সাধারণ কাপড় কি সুন্দর একটা নেকাব এ পরিণত হত। এসব দেখতে দেখতেই তার মাথায়, স্বপ্নে চলে আসত নতুন নতুন ডিজাইন। আর সে স্বপ্ন পূরণ করতে বসে যেত বাবার মেশিনে। বাবা কোন সময়েই বাধা দিত না। তবে পড়াশুনা আগে তারপর এসব। পড়াশুনা বরাবরই গুরুত্ব দিয়েছে পরিবার, আলিসার দুই ভাই স্কুলে ও এক বোন কলেজে পড়ে।
বাবার কথা অগ্রাহ্য করেনি আলিসা। পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে চলত নতুন ডিজাইনের খোঁজ। বাবারও ইচ্ছা ছিল মেয়ের এই প্রতিভাকে কাজে লাগানো।
আলিসা জানায়, বাবা মা-র কাছ থেকেই এসব কাজ শেখা।এটা পুরোপুরিটাই ফ্যামিল প্রফেশনাল। বাবা নেকাব এর হোলসেল বিজনেশ। কিন্তু এ থেকেই একটু অন্যমাত্রা দিতে চাই আমি নতুন নতুন কিছু করে। ফ্যাশন ডিজাইনে কোন ডিগ্রী না থাকলেও এবিষয়ে বহু কাজ আমার জানা। ওয়েস্ট মেটারিয়াল দিয়ে বিভিন্ন ধরণের পোশাক তৈরি করার অভিজ্ঞতা আছে। যেমন পেপার ক্যাটিং দিয়ে ব্যালন স্কার্ট, গারভেজ থ্রিলিয়ার লং স্কার্ট, হলুদের (ইওলো) উপর ব্লাক রোস দিয়ে ফ্যাশন ড্রেস – এছাড়াও ওয়েস্ট মেটিরিয়ালস দিয়ে তৈরি পেপার কাপস, কালারিং পেপার, নিউজ পেপার, গ্যারবেজ ব্যাগ, প্লাসটিক, থার্মোকাল প্লেট, প্লাসটিক চামচ, স্টু, শুকনো পাতার আস্তরণ দিয়ে বিভিন্ন ধরণের পোশাক। এগুলো মূলতঃ স্কুল কলেজ এর বা অন্যান্য কোন অনুষ্ঠানে ওয়েস্ট মেটিরিয়ালস বা অন্য কোন থিম এর উপর কোন ড্রেস বানানো হলে তখনই এটা ব্যবহার করা হয়। বছর খানেক আগে সিটি সেন্টার এ ক্রসওয়ার্ড এ এক কলেজের অনুষ্ঠানে তার এই ধরণের পোশাক ব্যবহার করা হয়।এছাড়া ফেবরিক, বিভিন্ন ধরণের হ্যান্ড ক্রাফট - গ্রিফট কার্ড, কার্ড বোর্ড, ফটো ফ্রেম, এসবও রীতিমত বাড়িতে বসে তৈরি করে।
তৈরি তো হলো। কিন্তু কিনবে কে!
পার্ক সার্কাসের এক রক্ষণশীল পরিবার, তাই বাড়ির বাইরে বের হওয়া বারণ। প্রতিভাকে কাজে লাগানোর পক্ষে যা প্রধান বাধা। কিন্তু কিছু তো করতেই হবে! ঘরে বসে যে তার প্রতিভাকে কাজে লাগানো যাবে না তা বুঝে যায় আলিসা। বাবা মাকে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে বাড়ীর কাছাকাছিই বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে পার্ট টাইম কাজে জয়েন করে। মাস গেলে কিছুটা হলেও টাকা হাতে পাচ্ছিল, যোগাযোগও বেড়ে চলে, নিজের কাজ প্রচার করার একটু হলেও জায়গা মেলে, আর এর ফলে নিজের স্বপ্নপূরণ করতেও অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছিল।
সবাই ঠিকঠাক চলছিল। ওলট পালট করে দিল করোনা। লকডাউনে স্তব্ধ হয়ে গেল শহর। বন্ধ হয়ে গেল বাবার বহুদিনের পুরোনা ব্যবসা। মাসের মাসের পর ব্যবসা বন্ধ থাকার ফলে হাত পড়ল জমা পুঁজিতে। জমা পুঁজি থেকেই চলছে সংসার। পুঁজি নেই, প্রচার নেই যার ফলে প্রতিভা বিকাশ হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সে এবং তার পরিবার।
লক ডাউনে আলিসার মাথায় এল মাক্স তৈরি করার নতুন এক পরিকল্পনা। কম পয়সায় সবার
হাতে স্বাস্থ্যসম্মত মাস্ক তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা। শুরু হল মাস্ক তৈরি। দাম ১০টা
থেকে ৩০ টাকা (উৎপাদন, চাহিদা বাড়লে কমবে দামও)।
মাস্ক তো তৈরি হলো। কিন্তু কিনবে কে! পৃথিবীর এই কঠিন অসুখে বাইরে বের হতে দিতে
নারাজ মা-বাবা। ফলে পরিবার এবং বন্ধু বান্ধবদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল সুন্দর সুন্দর
তৈরি হওয়া মাস্ক।
আলিসার কথায়, লকডাউনে বাবার কোন ইনকাম নেই। উৎসবের মরসুম ইদ, বকরিদ চলে গেল কোন অর্ডার পেলাম না। করোনা নিয়ে মানুষ যে আতঙ্কে তাতে নতুন কাপড় কেনাকেটার কথায় ভুলে গেছে। মানুষ বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে! কি যে সব হলো! আমারও এখন সেরকম মান্থলি কোন ফিক্সড ইনকাম নেই। আমি সেলফ ডিফেন্স হতে চাই। বাবা মাকে সাহায্য করতে চাই। আমি হাতাশ! করোনা কবে যাবে বলতে পারেন!
করোনা মহামারিতে সারা বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্থ। এদেশ, এরাজ্যও ব্যতিক্রম নয়। চারিদিকে শুধু হাহাকার, হতাশার ছবি। আমরা সবাই এই সময় লকডাউনের কারণে কিছুটা চাপে। সামাজিক, আর্থিক, রোগ সংক্রান্ত, ভবিষ্যত সংক্রান্ত নানা চিন্তা আমাদের জীবনকে চাপে রেখেছে। বহু লোকের ব্যবসা বন্ধ হয়েছে, চাকরি গেছে। ভয়ে, আতঙ্কে কোটি কোটি মানুষ এখন অবসাদে ভুগছে। পৃথিবীর এই অসুখ যে কবে ভালো হবে আমরা কেউই তা সঠিক ভাবে জানি না।শুধু এটুকু জানি একদিন না একদিন করোনা হারবেই, আমরা জিতবো।পৃথিবী আবার তার নিজস্ব ছন্দে ফিরে আসবে। আবার ব্যবসা-বানিজ্য শুরু হবে। নতুন ভাবে শুরু হবে কর্মসংস্থানও। আলিসাও আবার স্বপ্নপূরণের জায়গা পাবে, আত্মনির্ভর হয়ে মা-বাবা র পাশে দাঁড়াবে...তার আগে অত্যাধুনিক ডিজাইনে পোশাক,মাস্ক বা বিভিন্ন ধরণের হাতের কাজ দেখতে যোগাযোগ করতে পারেন... alishafasion786@gmail.com
No comments:
Post a Comment