প্রচন্ড গরমে কি করবেন
ওসিউর রহমানঃ প্রচন্ড রোদ ও ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ
হয়ে উঠেছে বাংলার জনজীবন। রাজ্যের কোথাও কোথাও বয়ে চলেছে মৃদু তাপপ্রবাহ। আগুন ঝরা এই রোদে অতিষ্ঠ হয়ে হাপিত্যেশ
করছে সবাই। অন্যদিকে আবহাওয়া দপ্তর বলছে,
এইরকম তাপমাত্রা থাকবে আরও বেশ কয়েকদিন। এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় আগামী দু
সপ্তাহ গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩৮ ডিগ্রির মতই থাকবে। দিনের তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রির কম
বেশি হলেও রাত্রের তাপমাত্রা প্রায় ১০ ডিগ্রি কমে গিয়ে ২৬ ডিগ্রির কমবেশি থাকবে।
The Weather Network থেকে জানায় যায়, ভোটের দিন কলকাতার তাপমাত্রা
প্রায় ৩৯ ডিগ্রি ছাড়াবে।
কেন এ
ধরণের সমস্যা দেখা দিচ্ছে ?
শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রচন্ড গরমে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে দেখা
দিচ্ছে এইসব নানারকম সমস্যা। এইসব সমস্যা এড়াতে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিগুলো অবশ্যই
মেনে চলতে হবে। প্রচন্ড এই গরমে যতটা সম্ভব
বাইরে বের না হওয়াই ভালো, রোদ এড়াতে টুপি দিয়ে মাথা ঢাকতে হবে, হালকা সূতির রঙের
জামাকাপড় পরতে হবে এবং প্রচুর পরিমানে জল (তিন থেকে চার লিটার) খেতে হবে। যারা
অফিসে এসিতে কাজ করছেন তাদের হয়ত অতটা জলের প্রয়োজন নাও হতে পারে তবে যারা বাইরে
রৌদ্রের মধ্যে কাজ করছে তাদের অবশ্যই বেশি করে জল খেতে হবে, দেখতে হবে যাতে শরীরে
জলের অভাব, নুনের অভাব না হয় - জানালেন মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল এর
কনসালট্যান্ট ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ সৌম্য পাত্র। তিনি আরও জানান, এইসময়
বাইরের খাবার দাবার এড়িয়ে চলায় ভালো, রাস্তার কাটা ফল একদম না খাওয়া। এসি তে থাকলে সময় করে এসি থেকে বাইরে বেরিয়ে
স্বাভাবিক তাপমাত্রায় থাকার অভ্যাস করুন। এসি থেকে সরাসরি প্রচন্ড গরমে বাইরে না
বেরানোই ভাল তাতে শারীরিক অসুবিধা হতে পারে।
এই প্রচন্ড তাপপ্রবাহে সান স্ট্রোক অথবা হিট স্ট্রোক এর
মত ভয়ংকর জীবন সংশয়কারি একটি সমস্যাও দেখা দিতে পারে। দেহের তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রী সেলসিয়াসের (১০৫.৮ ডিগ্রী ফারেন হাইট) বেশী
হলে সান স্ট্রোক বলা হয়। এর ফলে হৃদযন্ত্র থেকে রক্ত নির্গমন কম আসে, শরীরে ল্যাকটিক
অ্যাসিডের পরিমান বেড়ে যায় এবং ধমনীর মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়ে রক্তচলাচলে বিঘ্ন
ঘটায়।- জানালেন মেদিনীপুর কলেজ ও হাসপাতালের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর (জেনারেল সার্জারি) ডাঃ তুষারকান্তি চট্টোপাধ্যায়। তিনি আরও বলেন এইসব ক্ষেত্রে চিকিৎসা বা প্রাথমিক পরিষেবা পেতে দেরী
হলে রোগীর বিভিন্ন অঙ্গের কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে কিডনি বিকল হয়ে রোগীর
জীবনহানিও হতে পারে।
বিভিন্ন
অঙ্গের কার্যকারিতা নষ্ট ও কিডনি বিকল হয়ে রোগীর জীবনহানিও যাতে না হয় তা থেকে
রক্ষা পাবার উপায় জানালেন, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, শ্রীরামপুর শাখার
সভাপতি ডা প্রদীপ কুমার দাস। তিনি বলেন, ভুক্তভোগীকে সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা জায়গায়
নিয়ে গিয়ে তার জামাকাপড় খুলে দিয়ে বাতাস করা ও ঠান্ডা জলে তোয়ালে ডুবিয়ে বারে
বারে গা মুছিয়ে দেওয়া ও প্রচুর পরিমানে জল খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা। সমস্যা জটিল হলে
অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এইসময়
সর্দিগর্মি ও পেশির খিঁচুনির সমস্যাকে আটকানোর উপায় হিসাবে ডাঃ দাস বলেন, গরম
থেকে এসে সঙ্গে সঙ্গে জল না খেয়ে কিছুটা থিতিয়ে নেওয়ার পরে জল খেলে কিংবা চোখে
মুখে কিছুটা জলের ঝাপটা দেওয়ার পর জল খেলে সর্দিগর্মিকে আটকানো যেতে পারে। আর
পেশির খিঁচুনির সমস্যাকে আটকানোর জন্য বেশী পরিমানে জলীয় লবণ বারে খাওয়া বা ও আর
এস খাওয়া যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, হিট ফিভার হলে তার প্রতিকার হল বার বার জলীয়
খাবার খাওয়া, মাথা ধুইয়ে দেওয়া, বার বার গা মুছিয়ে দেওয়া ও প্যারাসিটেমাল জাতীয়
ওষুধ খাওয়া।
অন্যদের তুলনায়
শিশু ও বয়স্কদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকার কারণে বিপদের সম্ভাবনাও তাদের
ক্ষেত্রে অনেক বেশি। তাহলে কি করা উচিত বাবা-মায়েদের! বাবা-মা দের প্রতি পরামর্শ
দিতে গিয়ে কোলকাতা মেডিকেল কলেজের শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ কুন্তল বিশ্বাস বলেন, বাবা-মায়েদের বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত যাতে এই
প্রচন্ড রৌদ্দুরে বাচ্চারা বাইরে বার না হয়। যদি যেতেই হয় তাহলে সারা শরীর ঢাকা
পোষাক, চোখে সানগ্লাস এবং রৌদ্দুরে বার হওয়ার আগে বাচ্চাকে ভালো করে তরল পদার্থ
খাওয়ানো দরকার। বাচ্চাকে বেশিক্ষণ
রৌদ্দুরে না থাকতে দেওয়াই ভালো। যদি রাখতেই হয় তাহলে সান স্ক্রিন লোশন ব্যবহার
করা বা অন্ততঃ পক্ষে ছাতা বা মাথা ঢাকার ব্যবস্থা করা দরকার। সহজপাচ্য খাবার
খাওয়াতে হবে, দই বা ঘোল খাওয়ানোর প্রতি জোর দিতে হবে। কাটা ফল একদম খাওয়াবেন
না। যদি অবসন্ন লাগে তাহলে ও আর এস বা লবণ জল খাওয়ানো দরকার।
প্রচন্ড এই গরমে কম বেশি প্রায় সবারই ঘামাচি হয় সেই ঘামাচি
থেকে মুক্তির উপায় জানালেন মেডিকা হসপিটালের কনসালট্যান্ট ডার্মোলজিস্ট ডাঃ
অরিত্র সরকার। তিনি জানান, ঘামাচির নির্দিষ্ট কোনো
চিকিৎসা নেই। প্রতিরোধ করার জন্য ঢিলেঢালা সূতীর পোষাক বা শীতাতাপনিয়ন্ত্রিত বা
বাতানুকুল পরিবেশে ৫-৬ ঘন্টা সময় কাটানো বা বরফ ঠান্ডা জলে গা তিন চারবার স্পঞ্জ
করা খুব উপকারী।
অন্যদের
তুলনায় শিশুদের ঝুঁকি যেহেতু বেশি তাই এই তাপপ্রবাহে না বের হওয়া, পুরো হাতা
জামা, সঙ্গে ছাতা ব্যবহার পরামর্শ দেন কান্দি মহকুমা হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ
মহম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিকী। তিনি আরও বলেন, এই গরমে শিশুদের গায়ে ফোড়া হতে দেখা
যায়। এই সমস্যা থেকে বাঁচতে বাচ্চাকে
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। বার বার গা মুছিয়ে দিন, প্রয়োজনে বাচ্চাকে দিনে দুবার
স্নানও করানো যেতে পারে।
হাঁসফাঁস
অবস্থা রোযাদারদেরও। প্রচন্ড রোদ ও তাপপ্রবাহে গা থেকে দরদর করে ঘাম বের হচ্ছে।
তারাবি নামাজ আদায় করার সময়ও ঘেমে নেয়ে একাকার হচ্ছেন। প্রচন্ড রোদ ও তাপপ্রবাহেও
কিভাবে শরীর ভালো রেখে রোযা রাখা যায়, তারাবি পড়া যায় তার উপায় জানিয়েছেন ডাঃ
সেখ হাম্মাদুর রহমান (কনসালট্যান্ট এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগ, মেডিকা হাসপাতাল)।
তিনি বলেন, এই গরমে রোযাদার ব্যক্তি যে যে সমস্যার মধ্যে পড়তে পারেন, সেগুলো
হলো, ১. ডিহাইড্রেশন (শরীরে জলের মাত্রা কম হয়ে যাওয়া), ২. ইলেক্ট্রলাইট
ইমব্যালান্স (রক্তে লবণের মাত্রা কম বা
বেশি হওয়া), ৩. হাইপোগ্লাইসিমিয়া (রক্ত শর্করার পরিমান কম হওয়া) বিশেষ করে
ডায়াবেটিস বা প্রি-ডায়াবেটিসের রোগীদের এটা হতে পারে।
ডিহাইড্রেশনের
ফলে ব্লাড প্রেসার কম হতে পারে, তার ফলে শরীর নেতিয়ে পড়তে পারে। অনেক সময়
ডিহাইড্রেশনের ফলে মূত্রের সঙ্গে রক্তক্ষরণও হয়।
ইলেক্টলাইট ইমব্যালান্স হলে মাথা ব্যথা, মাংস পেশীত টান ধরা (বিশেষ করে
পায়ের পেশীতে) শরীর ঝিম ঝিম করা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া ইত্যাদি হতে পারে। রক্তে
শর্করার পরিমান কম হলে প্রচন্ড খিদে পাওয়া, মাথা ব্যথা, ঘাম হওয়া, হাত পা কাঁপা
ইত্যাদি হতে পারে। এমনকি রোযদার ব্যক্তি মূর্ছা পর্যন্ত যেতে পারে।
এইসব
সমস্যা থেকে বাঁচার উপায়ও তিনি জানান এই প্রতিবেদককে। তিনি জানান, এই সমস্ত
অসুবিধা থেকে বাঁচার জন্য রোযদার ব্যক্তিকে পার্যাপ্ত পরিমান জল খেতে হবে। দিনে
তিন থেকে সাড়ে তিন লিটার জল খাওয়া প্রয়োজন। অনাবশ্যক রৌদ্রে ঘোরাঘুরি করা নিষেধ।
তারাবির নামাজ পড়ার সময় অনেকসময় অল্প জায়গার মধ্যে অনেক সংখ্যক ব্যক্তি একসঙ্গে
নামাজ পড়ার কারণে ঘাম বেশি হয়। সেজন্যে তারাবির নামাজের মাঝে মাঝে জল বা সরবৎ
খাওয়া উচিত। এই সময় একটু বেশি লবণ খাওয়া উচিত। দিনে বাড়তি ৫-১০ গ্রাম লবণ জলের
সঙ্গে অথবা সরবতের সঙ্গে অথবা খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া উচিত। অবশ্যই যাদের
ব্লাড প্রেসার আছে তাঁরা ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বাড়তি লবণ খাবেন। যাতে রক্ত
শর্করা কম না হয়, তার জন্য সেহেরিতে শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়া দরকার (প্রোটিন এবং
ফ্যাট জাতীয় খাবারের সঙ্গে)। বিশেষ করে দুটো বা চারটে খেজুর সেহেরিতে খেলে রক্ত
শর্করা পরিমান কম হওয়ার সম্ভাবনা কম। এছাড়া ডায়াবেটিসের বা প্রি-ডায়াবেটিস যাদের
আছে তাঁদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলার পরামর্শ তিনি দেন।
ü প্রচুর পরিমানে জল পান করুন।
ü বাইরে বের হলে হালকা রঙের চওড়া টুপি অথবা ছাতা ব্যবহার
করুন। যাতে সুর্যের তাপ থেকে মাথা ও ঘাড়কে রক্ষা করা যায়।
ü হালকা, ঢিলেঢালা পোশাক
পরুন। পোশাক হালকা রঙের
হলেই ভাল হয় এবং সেই সঙ্গে সুতির কাপড় হলে আরো ভালো হয়।
ü মাথা ও মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখুন।
ü রোদের মধ্যে শ্রমসাধ্য কাজ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। সম্ভব হলে কাজটা খুব
সকালে বা রাতে করুন। যদি দিনে করতেই হয়, তবে কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম নিতে হবে ও প্রচুর পরিমানে জল ও
স্যালাইন (জলের সঙ্গে নুন),ফলের রস, লাচ্ছি পান করতে হবে। বাইরের কাটা ফল
একদম খাবেন না।
* তৃষ্ণা দিয়ে অনেক সময় বোঝা যায় না, প্রস্রাবের রঙই বুঝিয়ে
দেয় (ঘন হলুদ) শরীরে জলের অভাব।
গরমে
অত্যাধিক চা এবং মদ্যপান পরিহার করুন।
No comments:
Post a Comment