জিভ দেখে রোগ চেনা
ডা প্রদীপ কুমার দাস,
ডা প্রদীপ কুমার দাস,
সভাপতি, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল
অ্যাসোসিয়েশন, শ্রীরামপুর শাখা
জিভ দিয়ে আমরা খাবারের স্বাদ নিই। ঝাল, টক, তেতো বুঝতে পারি। জিভ না থাকলে কথা বলতে পারি না। জিভ দিয়ে আমরা কাউকে ভেঙাতে পারি অসৌজন্যতা প্রকাশ করতে পারি। আবার কারো দুঃখে কষ্টে জিভ নেড়ে সমবেদনা জানাতে পারি। আবার জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে প্রিয়জনকে ভালোবাসা জানাতে পারি। বড় বড় জীবজন্তুর মায়েরা জিভের সাহায্যে গা চেটে তাদের বাচ্চাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে থাকে। তাই জিভ আমাদের একটা অপরিহার্য্য অঙ্গ।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে
জিভ দেখে কি কি রোগ নির্ণয় করা যায়
চিকিৎসাবিজ্ঞানে জিভ দেখে অনেক রোগই চেনা যায়। যেমনঃ-
আকার দেখে
জিভের সাইজ বা আকার খুব বড় হলে তার এক্রোমেগালি, এমাইলোডোসিস
কিংবা জিভের টিউমার হয়েছে বলে সন্দেহ করতে পারি।
দুধের সরের মত সাদা
দাগ
জিভের ওপরতলে যদি দুধের সরের মত সাদা দাগ দেখা যায় এবং যেটা
জিভছোলা দিয়ে পরিষ্কার করলে উঠে যায়। সাধারণত এধরণের সাদা দেখতে পাওয়া যায় ক্যানডিডা
জাতীয় ছত্রাক সংক্রমণে। সেটা হতে পারে অত্যাধিক স্টেরোয়েড, ইনহেলার নেওয়ার ফলে
কিংবা এইচ আই ভি সংক্রমণে অথবা ক্যান্সার রোগের শেষ পর্যায়ে, যখন দেহের প্রতিরোধ
ক্ষমতা খুব কমে যায়।
চকচকে লাল মসৃণ
যদি জিভ চকচকে লাল মসৃণ হওয়ার কারণ জিভের অতি ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র ক্যাপিলাগুলো নষ্ট হওয়া। এধরণের ঘটনা আয়রণ,ফোলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন বি১২
পুষ্টির অভাবেও দেখা যায়। এছাড়া ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে সিলিয়াক ডিজিজ রোগে মসৃণ লাল
চকচকে জিভ দেখা য়ায়। লাল মসৃণ জিভকে চিকিৎসাশাস্ত্রে বলা হয় গ্লোসাইটিস । এরজন্যে
জিভের মধ্যে জ্বালা যন্ত্রণা থাকে সবসময় এবং খাওয়ার সময়ে সমস্যাটা খুব বেড়ে যায়।
ঝাল পড়লে তো আর কথা নেই। এ ধরণের ঘটনা খুব চিন্তাগ্রস্ত অথবা মানসিক অবসাদেও দেখা
যায়।
কম্পন
জিভ বের করলে যদি কম্পন বা ট্রেমার দেখা যায়- সেটা হতে পারে
মানসিক দুশ্চিন্তায়, থাইরয়েড রোগ, পারকিনসন্স রোগে ও ডিলিরিয়াম রোগের কারণে।
ঢেউ খেলানো
জিভের ওপরে ঢেউ খেলানো স্রোত বইতে থাকলে তাকে
চিকিৎসাশাস্ত্রে বলে ফ্যাসিকুলেশন । সেরকম ঘটনা দেখা যায় মোটর নিউরোন ডিজিজএ। যে রোগটিতে ভুগতে দেখা গিয়েছিল
পৃথিবী শ্রেষ্ট বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংসনসকে।
সাদা সাদা দাগ
জিভের ওপরে অনেক সময় সাদা সাদা ঝোপ ঝোপ দাগ দেখা যায়,
যেগুলো খুব করে ঘষলেও ওঠে না। এই সমস্যাকে বলা হয় লিউকোপ্লাকিয়া। যেটা ক্যান্সার রোগের পূর্ব অবস্থা বলে ভাবা হয়।
রঙ
⌘ জিভের রঙ বিশেষ করে জিভের তলায় লালচে আভা না দেখা গেলে
কিংবা সাদা ফ্যাকাসে বর্ণ হলে রোগী রক্তাল্পতায় ভুগছে বলে ধরে নিতে হয়।
⌘জিভের তলায় হলদেটে রঙ দেখা গেলে ধরে নিতে হবে সে জন্ডিস
রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
⌘ অনেক সময় জিভের উপরিভাগ ডগা ও দুইধার নীলচে রঙের হলে তার
অক্সিজেনের ঘাটতি হচ্ছে বলে ধরে নিতে হবে।
⌘ জন্মগত হৃদযন্ত্রের অসুখ, হৃদরোগ কিংবা ফুসফুসের অসুখে ঐ
ধরণের নীল রঙ জিভতে দেখা যায়।
⌘ জিভের রঙ কালচে বর্ণের হলে আয়রণের অভাব। আর্সেনিক, মারকারি
ধাতুর দুষণের জন্যেও ঘটতে পারে।
⌘ জিভ যদি লালচে কিংবা গাঢ় গোলাপি বর্ণের হয় ও জিভে
স্ট্রবেরি দানার মত ছোট ছোট দাগ দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে দেহের মধ্যে ভিটামিন
বি১২, ফলিক অ্যাসিডের অভাব ঘটেছে।
⌘অনেক সময় জ্বরের কারণে জিভ লাল ও দানাদর হয়ে যায়। জিভের
কোন স্থানে গাঢ় খয়েরী রঙ দেখা দিলে
অবশ্যই ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেওয়াটা খুব জরুরী। কেননা এধরণের দাগ ক্যান্সার রোগের
পূর্বলক্ষণ মাত্র।
⌘ জিভের রঙ কালো হলে আয়রণের অভাব ছাড়াও জীবানুর সংক্রমণ এটা
হতে পারে। এছাড়া অত্যাধিক ধূমপান ও আর্সেনিক দূষণের কথা ভাবতে হবে।
⌘ জিভের মধ্যে উজ্জ্বল লাল রঙ দেখা দিলে ধরে নিতে হবে পেটের
মধ্যে কোনও না কোন জীবানু সংক্রমণ হয়েছে। বিশেষ করে টাইফয়েড রোগের কথা ভাবা দরকার। প্রচুর পরিমানে
মশলাযুক্ত খাবার খাওয়া, অত্যাধিক স্নেহ ও তৈল জাতীয় খাবার খাওয়া ও মাত্রারিক্ত
সুরাপানে জিভের দুইধার লাল রঙের হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ
খেলে, মধুমেহ রোগে ভুগলে ও হাঁপানী রোগে ভুগলে অথবা পেটের অসুখে ভুগলে জিভে সাদা
সাদা দাগ দেখা যায়। রোগগুলিতে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ওই দাগগুলো চলে যায়।
ফাটা ফাটা/ লাল
রঙের রিং
যারা খুব ধূমপান করেন তাঁদের জিভের উপরিতলে ট্রাম লাইনের মত
ফাটা ফাটা হয়ে যায়। এছাড়া জিভে কতকগুলো লাল রঙের রিং ও রেখা জিভের ওপরিতলে দেখা যায়।
কোন কোন সুস্থ লোকেদের ক্ষেত্রে এটা দেখা যায়, তবে অনেক সময় ভিটামিন বি১২ পুষ্টির অভাবেও এ ঘটনা লক্ষ্য করা যায়।
কোন কোন সুস্থ লোকেদের ক্ষেত্রে এটা দেখা যায়, তবে অনেক সময় ভিটামিন বি১২ পুষ্টির অভাবেও এ ঘটনা লক্ষ্য করা যায়।
ঘা
জিভের মধ্যে অনেক সময় ঘা হতে দেখা যায়। জিভের দুটি ধারে,
জিভের ডগায়, ওপরের তলে কিংরা জিভের নীচের তলে। শামুকের চলাফেরার মত আকা বাকা ঘাট
জিভের ওপরিতলে দেখা গেলে সিফিনিটিক সেমি রোগ আক্রান্ত হয়েছে বলে সন্দেহ
করা হয়। এছাড়া যক্ষ্মা রোগ, ভিটামিনের অভাব ও ক্যান্সার রোগে জিভের মধ্যে ঘা হতে
দেখা যায়।
শুকনো/ভেজা ভেজা
জিভ যদি শুকনো খটখটে হয় তাহলে ধরে নিতে হবে দেহের মধ্য
পর্যাপ্ত পরিমান জলের অভাব ঘটছে অর্থাৎ ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ। যেটা সাধারণত কলেরা, ডায়েরিয়া, কিংবা
গ্যাস্ট্রোইনটারেটাইসিসে হয়ে থাকে।
আবার জিভ খুব ভেজা ভেজা থাকলে পারকিনসনস রোগে আক্রান্ত বলে
সন্দেহ করা যেতে পারে।
যদিও লজেন্স কিংবা চকলেট খেলে জিভে অতিরিক্ত জল আসে ও জিভ ভেজা থাকে।
যদিও লজেন্স কিংবা চকলেট খেলে জিভে অতিরিক্ত জল আসে ও জিভ ভেজা থাকে।
জড়তা বা অসাড়তা
জিভ দেখাতে বললে যদি জিভ বের করতে খুব কষ্ট হয় কিংবা বের
করার সময়ে একই দিকে অথবা অন্যদিকে বেঁকে যায়, তাহলে ধরে নিতে হবে স্নায়ুরোগ সে
আক্রান্ত হয়েছে।
জিভে কথা বলার সময়ে জড়তা বা অসাড়তা বোধ করলে স্ট্রোক বা
স্নায়ু ঘটিত পক্ষাঘাতের জন্যে এটা হতে পারে।
সমস্যা থেকে
মুক্তির উপায়
⌻ জিভ প্রতিদিন পরিষ্কার করুন।
⌻ বেশি গরম বা অন্য কোন গরম খাবার না খাওয়াই ভাল।
⌻ নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া দরকার।
⌻ কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে সেটা নিরাময় করা প্রয়োজন।
⌻দুপুরে কিংবা রাতে খাওয়ার পরে মুখ ভাল করে পরিষ্কার করটা
খুবই জরুরী।
⌻ধূমপান ও সুরাপান এড়িয়ে চলুন।
⌻ জিভে কোন ঘা কিংবা দাগ বেশিদন ধরে থাকলে তা অবহেলা না করে
চিকিৎসককে দেখান এবং তার পরামর্শমত চলুন।
No comments:
Post a Comment