আত্মহত্যার
প্রবণতা বাড়াচ্ছে জাঙ্ক ফুড!
ডাঃ কুন্তল বিশ্বাস
বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ, কোলকাতা
মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
বর্তমানে কমবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। কারণ অনুসন্ধান
করতে গিয়ে জানা গেছে তার মধ্যে একটি হল জাঙ্ক ফুড। জাঙ্ক ফুড, ফাস্ট ফুড ও রাস্তার
খাবার বা স্ট্রীট ফুড শব্দগুলি অনেকেই সমার্থক মনে করেন ও একসঙ্গে ব্যবহার করেন।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই তিনটির শব্দের অর্থ ও তাদের প্রভাব ও একরকম নয়।
ফাস্ট ফুড এর সংজ্ঞা হল – যে সব খাবার জীবনের দ্রুত গতির সঙ্গে তাল রেখে দ্রুত
খাওয়া যায়, তৈরী করতে খুব কম সময় লাগে বা সময় লাগেই না, এবং দামে ও সস্তা। স্ট্রীট ফুড- রাস্তার ধারে সস্তার বিক্রী হওয়া খাবার।
ফাস্ট ফুড মানেই জাঙ্ক ফুড নয়।
বাঙালী জীবনে বহুদিন ধরেই ফাস্ট ফুড চালু যথা ঝাল মুড়ি, ভেলপুরী, ফুচকা,সিঙাড়া, বেসনের লাড্ডু, মোওয়া ইত্যাদি।
ইংরাজীতে জাঙ্ক শব্দটি ব্যবহার করা হয় বাড়তি ও অপ্রয়োজনীয় উপাদান সম্বন্ধে।
১৯৭২ সালে সেন্টার ফর সায়েন্স ইন দি পাবলিক ইন্টারেস্ট এর ডাইরেক্টর মাইকেল
জ্যাকবসন এই শব্দটি অপ্রয়োজনীয় ও বাড়তি শক্তি সম্পন্ন খাবার সম্বন্ধে ব্যবহার
করেন। জাঙ্ক খাবারগুলি ও মুখরোচক, আর্কষণীয়, সাধারণ দামে কম হলেও এতে চর্বি,
মিষ্টি (রিফাইনড চিনি), লবণ ও শক্তি(ক্যালরি) বেশী মাত্রায় থাকে। এই খাবারগুলিতে
তাৎক্ষণিক ভাবে শরীরের কোনও বিপদ হয় না।
বরং সুষম খাবারের সঙ্গে মিলিয়ে এই খাবারগুলি খাওয়া হলে তা শরীরের পক্ষে নিরাপদই
থাকে। এগুলি উৎপাদনের সময় প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি খাদ্য সংক্রমণ হবার বিপদ থেকে
গ্রহীতাকে বাঁচানোর জন্য করা, সংরক্ষণ
করা ও বিক্রীর সময়ের নিরাপত্তার সম্বন্ধে সতর্কতা গ্রহণ করে। টেলিভিশন এ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এইসব খাবারগুলিকে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা সম্বন্ধে
ম্যকগর্ভান কমিটি ১৯৭৭ সালেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শিশু চিকিৎসকদের সংগঠন আমেরিকার অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্সের ছাড়পত্র ছাড়া টিভিতেও এই সমস্ত
বিজ্ঞাপন সম্প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। ভারতবর্ষে এই ধরণের কোনও ব্যবস্থাপনা নেই।
জাঙ্ক ফুড খাবার আগ্রহ তৈরীর কারণগুলি অনুসন্ধান করে তারও কতকগুলি তথ্য পাওয়া
গেছে। যথা- ২০০৭ সালে ব্রিটিশ জার্নাল অফ নিউট্রিশনের একটি রিপোর্টে দেখা গেছে যে
সমস্ত গর্ভবতী ইঁদুরদের জাঙ্ক ফুড খাওয়ান হয়েছে- তাদের সন্তানদের মধ্যে এইসব খাবারের
আগ্রহ বেশী।
সদ্যজাত অবস্থা থেকে ৬ মাস বয় অবধি
শুধু মাত্র বুকের দুধ ও তারপর শিশু যতদিন চাইবে ততদিন অবধি বুকের দুধ ও সঙ্গে
বড়দের খাওয়া দেখে ঠিক ভাবে প্রস্তুত বাড়ির খাওয়া মানব শিশু চাহিদা অনুযায়ী খেলে-
তাদের জাঙ্ক ফুডের জন্য আগ্রহ কম হয়। মানব শিশু সব কিছুই শেখে তার পারিপার্শ্বিক
থেকে। ফলে ৬ মাস বয়সের পর থেকে সহায়ক খাবার (কমপ্লিমেন্টরি ফুড) মানব শিশু তার
নিজের চাহিদা অনুযায়ী খেলে শিশুর জাঙ্ক ফুডের প্রতি আগ্রহ কম দেখায়। শিশুর খাওয়ার
চাহিদা তৈরী করার জন্য যে কয়টি দিকে নজর দিতে হয় তা হল খাবারের আকর্ষনীয় গন্ধ, রঙ,
স্বাদ ও পরিবেশ। এর জন্য শিশুর খাবার তৈরীর সময় তাকে খাবার তৈরী করার সময় সহায়তা
করতে দিলে, তার আগ্রহ তৈরী হয়। অভিভাবকরা এই বিষয়গুলি না বুঝে শিশুকে জোর করে
নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী খাওয়াতে গেলে –তার খাবার সম্ভন্ধে অনাগ্রহ তৈরী হয়। অভিভাবকরা
যদি সহজ পদ্ধতি হিসাবে শিশুকে জাঙ্ক ফুড ঘুষ দেয় তাহলে শিশুর ও চাহিদা তৈরী হয়ে
যায়। অনেক সময়েই অভিভাবকরা তাঁদের জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করে তার খাবারে
অনাগ্রহ তৈরী হবার ব্যবস্থা করেন। শিশু বিকল্প পদ্ধতি হিসাবে জাঙ্ক ফুড এর জন্য
বায়না করে – তা আদায় করে। সে ক্ষেত্রে শিশুর জাঙ্ক ফুড এর চাহিদা তার প্রতিবাদের
লক্ষণ। বাড়ির তৈরী খাবার গুলিকে আর্কষণীয় ও স্বাস্থ্যকর করার দিকে যদি অভিভাবকরা
নজর দেন ও শিশুদের পছন্দ অনুযায়ী তাকে বেছে নিতে দেন—তখন দেখা গেছে পাশাপাশি জাঙ্ক
ফুড দিলে শিশু প্রথমে জাঙ্ক ফুডই নেয়। তার কয়েকদিনের মধ্যে বড়দের পছন্দ করা থেকে
শিক্ষা নিয়ে আর জাঙ্ক ফুড নেয় না। অর্থাৎ শিশুর খাবার পছন্দ তৈরী করতে অভিভাবকদের
ও সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে।
স্ক্রিপ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পক্ষে ২০০৮ সালে পল জনসন ও পল জেনি গবেষণা করে সিদ্ধান্তে
আসেন – নিয়মিত জাঙ্ক ফুড খেলে মস্তিষ্কের কোষগুলি কোকেন এবং হেরোইনের
নেশাগ্রস্থের মত ব্যবহার করে। ফলে কয়েক দিনের মধ্যেই মস্তিষ্ক কোষগুলি আরও বেশী
পরিমানে জাঙ্ক ফুড খাবার পরিবেশ তৈরী করে।
খাবার ঠিকমত তৈরী না করলে সাধারণ খাবারও বাড়িতে জাঙ্ক ফুড এ পরিণত হতে পারে।
রান্না করার সময়ে তেল বেশী গরম করলে বা বারে বারে গরম করলে, খাবারে বনষ্পতি বা
ভেষজ ঘি ব্যবহার করলে, স্যাচুরেটেড ফ্যাট যথা, ঘি, মাখন, চর্বি এমনকি মার্জারিন
ইত্যাদি ট্র্যান্স ফ্যাটি অ্যাসিডে পরিণত হয়। ট্র্যান্স ফ্যাটি অ্যাসিড দেহের রক্ত
সংবহন তন্ত্রের নালীগুলির দেওয়ালে জমে থেকে স্ট্রোন হবার বিপদ বাড়ায়, যকৃৎ,
হৃৎপিন্ডের ক্ষতি করে।
পরিশ্রুত শর্করাতে শক্তি বা ক্যালোরি পাওয়া যায়। কিন্তু খাবারের অন্যান্য
প্রয়োজনীয় উপাদান পাওয়া যায় না। ফলে সুসামঞ্জস্য ব্যাহত হয়। তাই চিনি, মিছরি
(বিশেষত মাখন, মিছরি) ও জাঙ্ক ফুড।
খাদ্যগ্রহণের সঙ্গে শরীরের ব্যায়ামের ও সামঞ্জস্য থাকা দরকার। দৈনন্দিন
কাজগুলি করলে দেহ ক্লান্ত হয়, কিন্তু দেহের সর্ব অঙ্গের সঞ্চালন হয় না। ব্যায়াম বা
সর্বঅঙ্গ সঞ্চালন কম হলে দেহের মধ্যভাগে স্থূলত্ব বা ভুঁড়ি হয়। ভুঁড়ি হলে কতকগুলি
জীবন ধারার অসুখ- যথা- উচ্চ রক্তচাপ, হৃৎপিন্ডের অসুখ, ডায়াবেটিস, বেশীমাত্রার
কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড জনিত অসুখ কিডনির সমস্যা এমন কি ক্যান্সার হবার
বিপদ বাড়ে।
সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠার ২ ঘন্টার মধ্যে হালকা জলখাবার খলে হৃৎপিন্ডের অসুখ,
উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি ও এদের থেকে হওয়া স্ট্রোক হবার বিপদ কমে। সাধারণত ভোরের
দিকেই শরীরে গ্রোথ হরমোন এর ক্ষরণ হয়—যার ফলে শরীরে খাবার চাহিদা তৈরী হয়। তাই
ঘুম থেকে ওঠার ২ ঘন্টার মধ্যে ব্রেক ফাস্ট না খলে শরীরকে বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া
হয়। জল খাবারে তাই খাদ্যের সব ধরণের উপাদান যথা দানাশস্য, সবজি,ফল আমিষ দুধজাত
খাবার কম পরিমানে তেল জল ও ফাইবার বা আঁশজাতীয় জিনিস, লবণও ভিটামিন থাকা দরকার।
সারা দিনে খাবারের ৪-৫ বার বড় খাওয়া ও ৩-৪ বার হালকা খাওয়া গ্রহণ করা উচিত। এবং
কোনও বারেই যেন পরিমান যেন বেশী না হয়।
বেশী জাঙ্ক ফুড খেলে বা দীর্ঘদিন ধরে জাঙ্ক ফুড খেলে যেসব সমস্যাগুলি হতে
পারেঃ
১. শারীরিক অবসন্নতা – কারণ জাঙ্ক ফুড খেলে পেট ভর্তি লাগে, ক্ষিদে মিটে যায়
অথচ শরীর তার চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টি পায়
না। ফলে অবসন্নতা বোধ হয় এবং কাজ করার ইচ্ছা ও দক্ষতা দুই-ই কমে যায়।
২. হজমের বিঘ্নঃ যারা চর্বিযুক্ত
জাঙ্ক ফুড খায় – তাদের হজমের গন্ডগোলের ফলে অম্বল বা গ্যাসট্রো ইসবেজিয়াল
রিফ্ল্যাক্স ডিজজ (জি ই আর ডি), ঠিকমত পেট পরিস্কার না হওয়া বা ইরিটেবল বাওয়েল
ডিজিজ (আই বি ডি) হবার প্রবণতা বাড়ে। যদি খাবারটি বেশী গরম করা তেলে ভাজা হয়
(ড্রিপ ফ্রাই) তাহলে তেল ট্র্যাক্স ফ্যার্টি অ্যাসিডে পরিণত হয়। এই ট্রান্স ফ্যাটি
অ্যাসিড পাকস্থলীর ভেতরের দেওয়ালে উত্তেজিত হয়- ফলে বেশী পরিমানে অ্যাসিড নিঃসারণ
হয় ফলে শরীরে অস্বস্তি হয়।
রক্তে শর্করার পরিমাণের তারতম্য ঘটেঃ কারণ জাঙ্ক ফুডে রিফাইল্ড শর্করা বেশী
পরিমানে থাকে ফলে প্যানক্রিয়াস থেকে বেশী পরিমানে ইনসুলিন ক্ষরণ হয়, যাতে রক্তে
শর্করার মাত্রা বেশী বেড়ে না যায়। জাঙ্ক ফুডে শর্করা যৌগ ও প্রোটিন সঠিক পরিমানে
না থাকায় – এইসব খাবার খাওয়ার পর রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যায়। ফলে আরও জাঙ্ক ফুড
খাবার আগ্রহ বাড়ে। এবং মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।
৪. মস্তিষ্কের কার্যদক্ষতা কমে যায়ঃ জার্নাল অফ ব্রেন, বিভেবিয়ার অ্যান্ড
ইনিউনিটির একটি গবেষণায় বলা হয়েছে – এক সপ্তাহ ধরে ইঁদুরদের বেশী পরিমাণে জাঙ্ক
ফুড খাওয়ালে তাদের স্মৃতি শক্তি কমে যায়। জাঙ্ক ফুডে থাকা ট্র্যান্স ফ্যাট,
মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এর জায়গা দখল করে নেয়। ফলে মস্তিষ্ক কোষগুলির
স্বাভাবিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা করে দেখা
গেছে জাঙ্ক ফুড এর ফ্যাট নতুন কর্মদক্ষতা অর্জন করার ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়।
৫. হৃৎপিন্ডের ও রক্তসংবহণতন্ত্রের অসুখ হবার বিপদ বাড়ায়ঃ কারণ জাঙ্ক ফুড
রক্তের কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসাইড এর মাত্রা বাড়ায়। জাঙ্ক ফুড এর ট্র্যান্স
ফ্যাট শরীরে জমা হতে থাকায় হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক হবার সম্ভাবনা বাড়ায়।
কিডনির অসুখ হতে পারেঃ ট্র্যান্স ফ্যাট ও বেশী লবণের কারণে রক্তচাপ বাড়তে পারে ফলে কিডনী ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
৭. লিভারের ক্ষতি হতে পারে- কারণ জাঙ্ক ফুড এর ট্র্যান্স ফ্যাট লিভারেও গিয়ে
জমতে থাকে।
৮. টাইপ টু ডায়াবেটিস এর আশঙ্কা বাড়ে। জাঙ্ক ফুড হজমের ওপর চাপ বাড়ায়, ইনসুলিন
এর সঠিক ব্যবহারকে ব্যাহত করে ফলে এই অসুখ বেশী হবার আশঙ্কা।
৯.ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ায়ঃ ইউরোপীয়ান জার্নাল অফ ক্যানসার প্রিভেনসন
এর তথ্যে দেখা যাচ্ছে- জাঙ্ক ফুড এর শর্করা ও ফ্যাট – খাদ্যনালীর কোলেরেক্ট্যাল
ক্যান্সার হবার আশঙ্কা বাড়ায়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে যে সব পুরুষ বেশী পরিমানে কড়া ভাজা খাবার খান তাঁদের
প্রসটেট ক্যান্সার বেশী হয়।
১০. বয়সন্ধিকালীন ও কমবয়সী ছেলেমেয়েদের মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশন ঘটাতে পারে।
এই বয়সে শরীরে অনেক রকম হরমোনের পরিবর্তন হয়। স্বাস্থ্যকর খাবার শরীরের যে
ভারসাম্য রক্ষা করে -জাঙ্ক ফুড তা ব্যহত করে। ফলে ৫৮ শতাংশ অবধি মানসিক অবসাদ বা
ডিপ্রেশন বেড়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। জাঙ্ক ফুড খাওয়া শিশুদের স্থূলত্ব বাড়ে ফলে
তাদের গ্রোথ ও ডেভলপমেন্ট ঠিকমত হয় না। ফলে শিক্ষাগত মান ও কর্মদক্ষতাও
ক্ষতিগ্রস্থ হয়, সামাজিক সম্পর্ক খারাপ হয়। ফলে আত্মহত্যার মানসিকতা ও ঘটনা বাড়ছে।
তাই অকালে ঝরে যাওয়া বাঁচাতে অভিভাবক তথা সমাজকে সচেতন পদক্ষেপ নিতে হবে।
No comments:
Post a Comment