মাতৃদুগ্ধের বিকল্প কিছু নেই
ডাঃ মহম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিকী, শিশু বিশেষজ্ঞ
প্রতি বছর আগস্ট মাসের ১ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত সারা বিশ্বে 'ওয়ার্ল্ড ব্রেস্ট ফিডিং উইক' পালিত হয়।
প্রতি বছরের মতো এবছরও WABA (World Alliance for Breastfeeding Action) ব্রেস্ট ফিডিং সপ্তাহ পালন করছে আগষ্ট এর প্রথম সপ্তাহে। এর উদ্দেশ্য হল ব্রেস্ট ফিডিং এর যে অপরিসীম উপকারিতা মা ও বাচ্চার জন্য সেটা সাধারণ জনমানসে তুলে ধরা। প্রত্যেক বছর নির্দিষ্ট একটা থিম থাকে। এবছরের থিম হল BREASTFEEDING FOUNDATION OF
LIFE অর্থাৎ মাতৃদুগ্ধ জীবনের ভিত্তি।
ব্রেস্ট ফিডিং কখন শুরু করা উচিত?
ব্রেস্ট ফিডিং বাচ্চা জন্মানোর পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু করতে হবে। জন্মানোর পর বাচ্চাকে pre lacteal feeding হিসাবে মধু বা অন্য কিছু দেওয়া যাবে না। সাধারণত নরম্যাল ডেলিভারির ৩০ মিনিট এবং সিজারিয়ান ডেলিভারির চার ঘন্টার মধ্যে ব্রেস্ট ফিডিং শুরু করা দরকার।
কলোস্ট্রাম কি? / এর উপকারিতাই বা কি?
বাচ্চা জন্মানোর প্রথম অবস্থায় ব্রেস্ট থেকে প্রথম ৩-৪ দিন যে হালকা হলুদ রঙের দুধ বের হয় সেটাকে কোলোস্ট্রম বলে। বাংলাতে শালদুধও বলে। এটা বাচ্চার প্রথম ন্যাচারাল ভ্যাকসিন হিসাবে গণ্য হয় কারণ এতে রোগ প্রতিরোধক ইম্মুণোগ্লোবুলীণ, ভিটামিন এবং প্রোটিন থাকে যা বাচ্চার অপরিণত পরিপাকতন্ত্র কে পরিণত করতেও সাহায্য করে। পরিতাপের বিষয় হল এ দুধটাকে অনেকে অজ্ঞতার কারণে সেটা ফেলে দিয়ে বাচ্চার ক্ষতি করে।
ব্রেস্ট মিল্ক কত প্রকার?
১. কোলোস্ট্রাম - বাচ্চা জন্মানোর প্রথম অবস্থায় ব্রেস্ট থেকে প্রথম ৩-৪ দিন যে হালকা হলুদ রঙের দুধ বের হয় সেটাকে কোলোস্ট্রম বলে।
২. Transitional Milk- প্রথম ৩-৪ দিন পর থেকে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত যে দুধ বার হয় তাকে বলে Transitional Milk। এই দুধে ইম্মুণোগ্লোবুলীণ এবং প্রোটিন কমতে থাকে এবং ফ্যাট এবং সুগার এর পরিমান বাড়তে থাকে।
৩. Mature Milk- এটা Transitional Milk এর পর বের হয় জলের মত পাতলা, বাচ্চার গ্রোথ এর জন্য সমস্ত উপাদান এতে থাকে।
৪. Fore Milk- ব্রেস্টফিডিং শুরু করার প্রথমাবস্থায় এই দুধ বের হয়। এতে জলের ভাগ বেশী থাকে তার সাথে প্রোটিন, সুগার, ভিটামিন ইত্যাদি থাকে। এটা বাচ্চার তৃষ্ণা নিবারণ করে।
৫. Hind Milk- এটা বের হয় Fore Milk বের হবার পর। এতে ফ্যাট এর পরিমান বেশী থাকে এবং এনার্জী ও বেশী থাকে। এটা বাচ্চার ক্ষুধা নিবারণ করে।
২. Transitional Milk- প্রথম ৩-৪ দিন পর থেকে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত যে দুধ বার হয় তাকে বলে Transitional Milk। এই দুধে ইম্মুণোগ্লোবুলীণ এবং প্রোটিন কমতে থাকে এবং ফ্যাট এবং সুগার এর পরিমান বাড়তে থাকে।
৩. Mature Milk- এটা Transitional Milk এর পর বের হয় জলের মত পাতলা, বাচ্চার গ্রোথ এর জন্য সমস্ত উপাদান এতে থাকে।
৪. Fore Milk- ব্রেস্টফিডিং শুরু করার প্রথমাবস্থায় এই দুধ বের হয়। এতে জলের ভাগ বেশী থাকে তার সাথে প্রোটিন, সুগার, ভিটামিন ইত্যাদি থাকে। এটা বাচ্চার তৃষ্ণা নিবারণ করে।
৫. Hind Milk- এটা বের হয় Fore Milk বের হবার পর। এতে ফ্যাট এর পরিমান বেশী থাকে এবং এনার্জী ও বেশী থাকে। এটা বাচ্চার ক্ষুধা নিবারণ করে।
কিভাবে বাচ্চার ব্রেস্টফিডিং করাবেন?
মায়ের পজিশন- মা নিজের যে কোনো আরামদায়ক পিছনের দিক সাপোর্ট অবস্থায় ব্রেস্টফিডিং করাতে পারে। মা যেন বাচ্চার দিকে ঝুকে না যায়।
বাচ্চার পজিশন-
১. বাচ্চার গোটা শরীর ভালো ভাবে সাপোর্ট দিয়ে রাখতে হবে।
২. মাথা, ঘাড় এবং শরীর একই লাইনে থাকবে।
৩. বাচ্চার শরীর মায়ের দিকে ঘুরে থাকবে। বাচ্চার পেট মায়ের পেটে ঠেকে থাকবে।
সঠিক পজিশনের পর বাচ্চার গালে হাত দিলে বাচ্চার মুখ খুলবে। সঠিক attachment মানে হলো
ক. বাচ্চার মুখ বড় করে খোলা থাকবে। ব্রেস্ট এর নিপল এবং চারিপাশের কালো অংশের বেশীরভাগ বাচ্চার মুখের ভিতর থাকবে। উপরের কালো অংশ সামান্য দেখা যেতে পারে কিন্তু নিচের কালো অংশ যেন কোন ভাবেই দেখা না যায়।
খ. বাচ্চার থুতনি ব্রেস্ট এ ঠেকে থাকবে।
গ. নিচের ঠোটটা উল্টানো থাকবে।
কতক্ষণ ব্রেস্টফিডিং করাবেন?
১৫-২০ মিনিট ধরে একটা ব্রেস্টফিডিং করাতেই হবে কারণ প্রথমাবস্থায় Fore Milk আসে এবং পরের দিকে Hind Milk বের হয় যেটাতে প্রচুর ফ্যাট এবং এনার্জি থাকে বাচ্চার ক্ষুধা নিবারণ করে।
বাচ্চাকে ডিমান্ড ফিডিং করাতে হবে। ডিমান্ড ফিডিং মানে বাচ্চা যখন চাইবে তখন খাওয়াতে হবে। ঘড়ি দেখে ব্রেস্টফিডিং না করিয়ে বেবি দেখে ব্রেস্টফিডিং করাতে হবে।
২৪ ঘন্টায় ৮-১২ বার খাওয়াতে হবে।
বাচ্চার চাহিদা কি করে বোঝা যাবে?
১. বাচ্চা হাত, পা বেশী নাড়বে
২. মুখে হাত দিবে। জিভ বের করবে।
৩. কোন কাপড় পেলে মুখে দেওয়ার চেষ্টা করবে
৪. ঠোঁট নাড়বে। মুখ খুলবে।
৫. কান্না অনেক পরের লক্ষণ। এর জন্য অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
কি করে বুঝবেন বাচ্চা পর্যাপ্ত দুধ পান করছে?
১. বাচ্চা যদি ৬-৮ বার প্রসাব করে ২৪ ঘন্টায়
২. ২-৩ ঘন্টায় ঘুমায় দুধ পান করার পর
৩. যদি ওজন বৃদ্ধি হতে থাকে।
ব্রেস্টফিডিং এর পর কি করবেন?
বাচ্চা দুধ খাওয়ার সময় অনেক বাতাস পাকস্থলীতে চলে যায়। যার জন্য পেট ফুলে যায়, পেট ব্যথা করে বাচ্চা দুধ তুলে। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বার্পীণ্গ অর্থাৎ বাচ্চাকে কাধে অথবা উপুড় করে রেখে পিঠে বাড়ি মারতে হবে এর ফলে পাকস্থলীর বাতাস বাইরে বের হয়ে যাবে।
অনেক মা অভিযোগ করেন যে পর্যাপ্ত দুধ হচ্ছে না এর কারণ কি এবং প্রতিকার?
এখন বেশীরভাগ মা অভিযোগ করেন যে ব্রেস্ট মিল্ক পর্যাপ্ত হচ্ছে না। কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা ঠিক না।
১. মায়েরা ভাবেন যে বাচ্চা কান্নাকাটি করছে মানে ব্রেস্ট মিল্ক খাওয়ার জন্য কাঁদছে সেটা কিন্তু ঠিক না, বাচ্চা অনেক কারণেই কান্নাকাটি করে।
২. ব্রেস্ট মিল্ক খাওয়ানোর পদ্ধতি ঠিক না হওয়ার ফলে বাচ্চা মিল্ক কম পায়।
৩. অনেক মা বোতল ফিড করান। যার জন্য বাচ্চা ব্রেস্ট মিল্ক নিতে চায় না কারণ ব্রেস্ট মিল্ক টানতে বাচ্চার পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু বোতল ফিড এ সেইরকম পরিশ্রম দরকার হয় না।
৪. যে মায়েরা ব্রেস্ট মিল্ক খাওয়ায় তাদের এক্সর্টা ৪০০-৫০০ ক্যালোরি এবং ২৫ গ্রাম প্রোটিন দরকার, যেটা বেশীর ক্ষেত্রে পূরণ হয় না।
৫. ব্রেস্ট ফিডিং মায়ের পর্যাপ্ত আরাম দরকার, যেটা অনেক ক্ষেত্রেই হয় না।
৬. রাত্রে ব্রেস্ট মিল্ক বেশী তৈরী হয় তাই ব্রেস্ট মিল্ক পর্যাপ্ত হওয়ার জন্য রাত্রিতে ফিডিং খুব দরকারী।
৭. মাকে ব্রেস্টফিডিং এর ব্যপারে অত্মাবিস্য়াশি হতে হবে।
কোন কোন ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ফিড খাওয়ানো উচিত নয়?
১. ল্যাকটোজেন ইনটোলারেন্স ( lactogen intolerance)
২. গ্যালাকটোসেমিয়া (galactosemia)
৩. মা কোনো অ্যান্টি ক্যান্সার, অ্যান্টি থাইরয়েড অথবা লিথিয়াম ওষুধ খেলে।
৪. মায়ের অ্যাক্টিভ টিউবারকিউলোসিস এর প্রথম ২ সপ্তাহ।
৫. আমাদের দেশে মা এইচ আই ভি (HIV)-তে আক্রান্ত হলেও ব্রেস্ট ফিডিং করাবে। অবশ্যই ডাক্তর এর সাথে পরামর্শ করা উচিৎ ।
ব্রেস্ট মিল্ক খাওয়ানোর উপকারিতা কি কি?
১. সহজলভ্য এবং ইকোনমিক্যাল
২. Physiological কারণ
ক. প্রচুর ল্যাকটোজ থাকে
খ. whey protein থাকে
গ. Long chain polyunsaturated fatty acid থাকে
ঘ. শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্য যে সব উৎসেচক লাগে সেগুলি থাকে।
ঙ. বৃদ্ধিতে সহায়ক ফ্যাক্টর থাকে। ব্রেন ডেভোলপমেন্ট এবং চোখের জ্যোতি বাড়ায়।
৩. রোগ প্রতিরোধের জন্য antimicrobial
factor থাকে
৪. মা এবং শিশুর মধ্যে বন্ধন সুদৃঢ় হয় এবং আবেগ ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্নয়নে সাহায্য করে।
৫. ব্রেস্ট ফিড বেবীর ১৪ গুন কম ডায়রিয়া, ৪ গুন কম শ্বাসকষ্ট ও ২.৫ গুন কম অন্যান্য ইনফেকশন হয়।
৬. ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ, একজিমা, অ্যাজমা, অ্যালার্জী কম হয়।
মায়ের উপকারিতা
ক. জন্মের পর মায়ের জরায়ু থেকে রক্তপাত কম হয়।ন্যাচারাল contraception এর কাজ করে ।
খ. জরায়ু আগের অবস্থায় তাড়াতাড়ি ফিরে যায়।
গ. স্তন এবং জরায়ু ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমে।
আর্টিফিসিয়াল মিল্ক এর অপকারিতা কি কি
আর্টিফিসিয়াল মিল্ক খাওয়ানো এখন প্রতিযোগীতার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মায়েদের মনে এখন এই ধারণা জন্মেছে যে আর্টিফিসিয়াল মিল্ক না খাওয়ালে বাচ্চা সঠিক বাড়বে না । যেটা সর্বৈব ভুল ধারণা। ব্রেস্ট মিল্ক খাওয়ানোর নিষেধ যেগুলো বলা হয়েছে সেগুলো ছাড়া কোন অবস্থাতেই আর্টিফিসিয়াল মিল্ক খাওয়ানো ঠিক না। আর্টিফিসিয়াল মিল্ক খাওয়ালে বাচ্চা ব্রেস্ট মিল্ক ততটা বেশী খাবে না যেটা বাচ্চার পক্ষে খারাপ।
আর্টিফিসিয়াল মিল্ক খাওয়ালে
১. বাচ্চা অপুষ্টি (malnutrition) এ ভুগতে পারে কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডাইলুটেড মিল্ক খাওয়ানো হয়।
২. ইনফেকশন এর সম্ভাবনা থাকে
৩. ব্রেস্ট মিল্ক এর মতো অ্যান্টি ইনফেকটিভ জিনিস থাকে না।
৪. অ্যাজমা, অ্যালার্জী, ডায়াবেটিস, ওবেসিটি, হাইপারটেনশন এর মতো রোগ হতে পারে।
৫. গরুর দুধের ও অনেক অপকারিতা আছে। পরিহার করতে পারলে ভালো হয়।
কর্মরত মায়েরা কি করবেন?
১. যতটা সম্ভব মেটারনিটি লিভ নেওয়া
২. বের হবার আগে এবং ঘরে ঢুকে ব্রেস্ট ফ্রিডিং করানো
৩. ব্রেস্ট মিল্ক express করে রাখা। express milk ঘরের তাপমাত্রায় ৬ ঘন্টা এবং ফ্রিজ এ ২৪ ঘন্টা রাখা যায়। ফ্রিজ করা দুধ গরম জলে রেখে গরম করতে হবে। ফুটালে ভিটামিন সিএবং অ্যান্টি ইনফেকটিভ পদার্থ নষ্ট হয়ে যায়।
কমপ্লিমেন্টারি ফিডিং কখন শুরু করবেন?
৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ এমনকি জল ও না। শুধুমাত্র ওষুধ খাওয়াতে পারেন। এর পর মায়ের দুধ দিয়ে শিশুর প্রয়োজনীয় ক্যালোরী পূরণ হয় না। তাই বাড়ির খাবার শুরু করতে হয়। প্রথমে গলা ভাত, নরম শাকসবজি, কলা, সুজি। তারপর খিচুড়ি, বিভিন্ন রকমের ফল শুরু করতে হবে। এরপর শক্ত খাবার, উত্তম হয় যদি পরিবারের সদস্যদের সাথে একসাথে নিজের হাতে বাচ্চা খায়। বুকের দুধ ২ বছর পর্যন্ত চলবে । যে বাচ্চারা শুধু ব্রেস্ট ফিডিং করে তাদের এক বছর বয়স পর্যন্ত ভিটামিন ‘ডি’ ডাক্তার এর পরামর্শ মতো খাওয়ানো উচিৎ । সাক্ষাৎকারঃ ওসিউর রহমান, ৭৯৮০১৫৫২৭৭
No comments:
Post a Comment