পেটে ব্যথা
ডাঃ মুন্সি
তাজরুল ইসলাম
কমবেশি
প্রায় সবাইকে কোনো না কোনো সময়ে পেটে ব্যথার মত সমস্যায় ভুগতে হয়। পেট
জ্বালাপোড়া কিংবা অ্যাসিডিটির
মত সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়। কারও কারও আবার এটা একটা নিত্যমিত্তিক ঘটনা হয়ে
দাঁড়িয়েছে। সাধারণত অনিয়মিত খাবার খাওয়া, অতিরিক্ত ঝাল খাবার, ফাস্ট ফুড খাবার খাওয়া, অতিরিক্ত ওজন, অতিরিক্ত
মদ্যপান, পেটে ব্যথার কারণ হতে পারে জানাচ্ছেন, ডাঃ মুন্সি তাজরুল ইসলাম
পেটে
ব্যথা কেন হয়
পেটে
ব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তবে প্রায় সব ব্যথারই মূল কারণ অনিয়মিত
খাওয়া-দাওয়া, অতিরিক্ত চর্বি বা তেলজাতীয়, গুরুপাক খাবার ।
সেইজন্য হাইপার অ্যাসিডি হয় তা থেকেও বেদনা হতে পারে। প্রায় অধিকাংশই ক্ষেত্রেই
এটা হচ্ছে।
পেটে
অ্যাসডিটি ছাড়াও অ্যাপেন্ডিসাইটিস, কিডনিতে পাথর, কোষ্ঠকাঠিন্য, এছাড়া ক্রনিক
আমাশয় থেকেও ব্যথা হতে পারে। সাধারণ আমাশয়, ফুড পয়জনিং ও বদহজম থেকেও ব্যথা
পেটজুড়ে ব্যথা হতে পারে।
অ্যাসিডিটি
কি
অনিয়মিত
খাওয়া-দাওয়া, অতিরিক্ত চর্বি বা তেলজাতীয়, গুরুপাক খাবার
জাংক ফুড, ফাস্ট ফুড- এই সব খাবার খাওয়ার ফলে পাকস্থলীতে অতিরিক্ত
অম্ল বা অ্যাসিডের উপস্থিতির ফলে
পরিপাক প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এবং সেই কারণেও পেটে ব্যথা, পেট জ্বালা,
বুকে জ্বালাপেআড়ার মত যন্ত্রণা হতে থাকে। সেই
সঙ্গে টক ঢেঁকুর ওঠে। মাঝে মাঝে বমি হয়, পেট ভার
হয়ে থাকে। এটা অ্যাসিডিটির জন্য হয়।
অ্যাসিডিটি
হওয়ার কারণ কি
অনিমিয়ত
জীবনযাপন, খাওয়াদাওয়া করা,
অনেকক্ষণ
না খেয়ে থাকা,
অতিরিক্ত
তেল-মশলা দেওয়া খাবার খাওয়া, ফাস্টফুড বেশি মাত্রায় খাওয়া
জল
কম খাওয়া।
নিয়মিত
শরীরচর্চা না করা
এছাড়া
দুঃশ্চিন্তা বা স্ট্রেস থেকেও হতে পারে।।
কি করে এ
সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায়
লিভারকে
যদি সুস্থ রাখতে হয় তাহলে খাওয়া দাওয়ার একটা নির্দিষ্ট নিয়ম করতে হবে। তাহলেই অ্যাসিডিটি
নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। সময়মত খেতে হবে এবং তার সঙ্গে গুরুপাক খাওয়া একদম
কমিয়ে দিতে হবে। দুপুরের বা রাতে খাবার পর একটু হাটাঁচলা করতে হবে। সেই সঙ্গে পেট যাতে
পরিষ্কার থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
আবার
অনেকক্ষণ খালি পেটে থাকাও ঠিক নয়। খালি পেট সব সময় অ্যাসিডিটি বা গ্যাসের আশঙ্কা
বাড়িয়ে দেয়। তাই গোড়াতেই নিয়ন্ত্ৰণ করার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন,
না হলে পরবর্তীকালে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আলসার বা গ্যাসট্রিকের
সমস্যা কি করে বুঝবো
আলসার বা
গ্যাস্ট্রিকের
ব্যথা সাধারণত পেটের ওপর দিকে মাঝখানে হয়। বমি বমি ভাব, বদহজম হওয়া, বুক
জ্বালাপোড়া করা, অতিরিক্ত
গ্যাস জমে যাওয়ার ফলে মাথা ঘোরার মত সমস্যা ও দেখা দেয়। আলসার
বা গ্যাসট্রিকের সমস্যা আলাদা। গ্যাসট্রিক বহুদিন হলে আলসার হয় তখন লিভারে হাত
দিলে বেশ টাইট মত লাগবে। একই জায়গায় ব্যথাটা হবে।
যেহেতু নাড়িটা একটা জায়গায় আটকে গিয়েছে সেহেতু খাবার খেলে লিভারগুলো নিতে
পারছে না কারণ মাঝখানটা আটকে গেছে।
একটু ব্যথা
হলেই মানুষ দোকান থেকে গ্যাসের ওষুধ কিনে খাই, ব্যথা ভালোও হয়ে যায়। এটা কিন্তু
ট্রিটমেন্ট নয়। বারে বারে দোকান থেকে গ্যাসের ওষুধ কিনে খাওয়া,এটা একদম ঠিক নয়। এতে
শরীরের প্রচুর ক্ষতি হতে পারে। যারা দীর্ঘদিন গ্যাসের সমস্যায় ভুগছে তাদের আলসার
হতে পারে। ঐ ঘা থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস
অ্যাপেন্ডিক্স
এর কারণেও পেটে ব্যথা হতে পারে।
অ্যাপেন্ডিক্স শরীরের একটি বাড়তি অংশ। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে
শিশু জন্মের সময় ওটা কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এদেশে
সেটা হয় না। অ্যাপেন্ডিক্স প্রত্যেকেরই আছে। মানুষ যত বড় হতে থাকে ওটাও তত বাড়তে
থাকে। এটা অপারেশন করতে হয়। পাশ্চাত্য দেশে এটা রোগ নয়। যেকোন সময়ে এটা অসুবিধা
করতে পারে। যন্ত্রণা হলে চিকিৎসকের পরামর্শমত পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে। কোনো কারণে
অ্যাপেন্ডিক্স জীবাণুর আক্রমণে সংক্রমণ হলে অ্যাপেন্ডিক্স ব্যথা হতে শুরু হয়।
পেটে ব্যথার সাথে সাথে বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, খিদে না পাওয়া, জ্বর জ্বর ভাব ইত্যাদি
লক্ষণ দেখা দেয়। সেই সময় এটা অপারেশন করে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। অপারেশন
না করা হলে, কোনো কারণে ফেটে গেলে তা মারাত্মক সমস্যারূপে দেখা দিতে পারে।
কিডনিতে পাথর
কিডনিতে
পাথর হওয়ার কারণে পেটে ব্যথা হয়। এতে তলপেট থেকে ব্যথাটা ছড়িয়ে কোমরের দিকে যায়। কোমর থেকে তলপেটে ব্যথা ছড়িয়ে
পড়তে পারে। সেই সঙ্গে বমি বমি ভাব, বমি হওয়া,
মূত্রত্যাগের সময় ব্যথা,
মূত্রে রক্তের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, জ্বর জ্বর ভাব বা ঘন ঘন জ্বর আসা ইত্যাদি
লক্ষণ দেখা দেয়। পেটের ওপরের দিকে ডান অথবা বাঁ কিডনিতে পাথর, প্রদাহ বা
সংক্রমণ হলে সেই
পাশে ও পেছনে ব্যথা হয়। এই ব্যথা ক্রমেই নিচে নেমে তলপেটেও ছড়ায়। কিডনির ব্যথা
প্রচণ্ড তীব্র হয়, একটু
পরপর ছাড়ে, আবার
আসে। সঙ্গে বমি, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর
থাকতে পারে।
ইন্টেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন
খাবার এবং তরল ক্ষুদ্রান্ত্রে অথবা বৃহদন্ত্রে পৌছাতে যখন
সমস্যা দেখা দেয় অর্থাৎ নাড়িটা উল্টে যায় তখন তাকে ইন্টেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন বলে । এতেও পেটে তীক্ষ্ম ব্যথা হয়। নীচের পেটাটা টাইট হয়ে যায়, পেচ্ছাব
আটকে যায়, পায়খানা হতে চায় না। এমনকি কিডনিরও ক্ষতি হয়। এটা কি থেকে হচ্ছে জানতে
গেলে ব্যথা অবস্থায় আলট্রাসোনাগ্রাফি করতে হবে। এক্ষেত্রে দেখা গেছে নামীদামী
গ্রুপের ওষুধ খেলেও ব্যথা কমতে চাই না, তখন অবশ্যই অপারেশনের প্রয়োজন হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির ঠিকমত চিকিৎসা করা না
হলে অন্ত্রের আক্রান্ত অংশটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায়। ফলে বিভিন্ন ধরনের শরীরিক
সমস্যা দেখা দেয়।
এটা প্রতিরোধ করার জন্য খেতে হবে প্রচুর পরিমানে আঁশযুক্ত
খাবার।
সেই সঙ্গে প্রচুর পরিমানে সবুজ শাকসবজি,
ফলমূল এবং জল পান করতে হবে। বর্জন করতে
হবে জাঙ্কফুড, ফাস্ট ফুড, চর্বি ও তৈলাক্ত জাতীয়
খাবার।
কোষ্ঠকাঠিন্য
পেটে ব্যথা
হওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা। বৃহদান্ত্রের
শেষভাগে জমা
মল সাধারণত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শরীরের বাইরে বার হয়ে যায়। কিন্তু
বহুদিন ধরে চলা কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার ফলে মল এত বেশি শক্ত হয় যে
তা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শরীরের বাইরে বের হতে পারে না। তখন পেট বেশ টাইট হয়ে যায় এবং
ব্যথা হয়। এক্ষেত্রে পায়খানাটা আটকে আটকে হয়। আবার কারো বেশ কয়েকদিন পর পর
শক্তপায়খানা হয়। সেই সঙ্গে পেট ফেঁপে যাওয়া, নিচের পিঠে
ব্যথা ও মলত্যাগ করার সময় মূত্রাশয়ে চাপ পড়ার মত সমস্যা দেখা
দেয়। এক্ষেত্রে আমরা পেঁপে, পাকা কলা খাওয়ার পরামর্শ দিই। সেই সঙ্গে বেশি পরিমানে
জল খেতে বলি। আগে তো এত ওষুধ ছিল
না। লোক বেলের সরবৎ, বেল পুড়িয়ে খেত। এখন
আর মানুষ ওসব খায় না সময়ের কারণে। এগুলো খেলে প্রাথমিক ট্টিটমেন্টেই সেরে যেত
এইসব।
যদি তার
পরেও সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে ওষুধ দেওয়া হয়। কোষ্টকাঠিন্য কেন হচ্ছে সেটা
দেখতে হবে। কোষ্টকাঠিন্য হওয়ার আসল কারণ হল যখন তখন যা ইচ্ছা হয় তাই খাওয়া, তার
ফলে লিভারটা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যায়। লিভারটা দুর্বল হয়ে গেলে পিত্ত যে রসটা
থাকে, যেটা হজম করতে সাহায্য করে, সেটা শুকিয়ে যায়। তখনই কোষ্টকাঠিন্য হয়।
প্রথমেই ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। সব বয়সেরই এটা হতে দেখা যায়। মূলত ফাইবারযুক্ত খাবার
পর্যাপ্ত পরিমানে না খাওয়া, জীবনশৈলীর পরিবর্তন এবং পরিমান মত জল না খাওয়ার জন্যই
এটা হয়। ৫০ বছরে উপর হয়ে গেলেই কোষ্টকাঠিন্য একটা আসে।
এছাড়া
ক্রনিক আমাশয় থেকেও হতে পারে। সাধারণ আমাশয়, ফুড পয়জনিং ও বদহজম থেকে পেটজুড়ে ব্যথা
হতে দেখা যায়। বমি বমি ভাব, পেটে গুইগায় শব্দ, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি হয়।
লিভারের
পিত্তরস যখন শুকিয়ে যায় বয়স অনুযায়ী যে রসটা থাকলে খাদ্য ঠিক ডায়োলেট হবে।
অনিয়মিত খাবারই মূল কারণ। যারা ড্রিংক্স , তৈলাক্ত খাবার বেশি পরিমানে না খাওয়াই
ভাল।
পরামর্শ
* শরীরটাকে
বাচাতে গেলে আগে পেটাকে বাঁচাতে হবে।
* চর্বি জাতীয়
খাবার লিভার নিতে পারে না। তাই লিভার টাকে ঠিক রাখতে চর্বি তৈলাক্ত জাতীয় খাবার কম
খেতে হবে।
* চর্বি জাতীয়
খাবার বন্ধ করে দিলে শরীর সুস্থ থাকবে।
* মাংস বেশি
খাওয়া ঠিক নয়।
* রাত্রে
শোওয়ার সময় চার চামচ ইসুবগুলোর ভুষি গরম জল খেলে প্রচুর উপকার পাওয়া যায়। দেখা
যাবে ৭৫ শতাংশ এর ক্ষেত্রে গ্যাস জাতীয় সমস্যা আর হবে না।
* নেশা অবশ্যই
বাদ দিতে হবে।
গ্যাসের
জন্য কোন ওষুধ নিয়মিত খেতে নেই। এখনকার লোকেরা যখন তখন খাচ্ছে। ওটা তো
ট্রিটমেন্ট নয়। সাময়িক কমল। এখন আমরা বলছি যে গ্যাসের ওষুধ না খাওয়ালেই ভালো।
কোটি কোটি টাকা গ্যাসের ওষুধ বিক্রি হয়। দিনে মনে হয় কয়েক লক্ষ কোটি টাকার
গ্যাসের ওষুধ বিক্রি হয়। এটাতে তাদের লাভ, আপনার ক্ষতি।
এছাড়া
খাবারের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। খেতে হবে লাইট ফুড, হালকা মশলা দিতে হবে। আমরা যে
লঙ্কার গুড়ো খাই সেটা লঙ্কার গুড়া নয়, কেমিক্যাল। যা শরীরের পক্ষে মারাত্মক
ক্ষতি। সবচেয়ে ভাল কাঁচা লঙ্কার তরকারি খাওয়া। সপ্তাহে একদিন মাংস ঠিক আছে। সকালে
ওঠে খালি পেটে ইসবগুলের সরবৎ করে পতিনগুললি ওটা ভিজিয় এক গ্লাস খেয়ে নিলে এক দুবার
পেচ্ছাব হয়ে যাবে। তারপরে একটু ভারী ধরণের খেতে হবে। এটা লিভারকে ঠান্ডা করার
জন্য। ওষুধকে বর্জন করতে হবে। সকালবেলা উঠেই অনেকেই উঠে চা খাই এটা ঠিক নয়। বাতাসা
খাওয়া যেতে পারে। ইসবগুল নিয়মিত খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য আর হবে না খুব একটা। তাই পেট
ব্যথার সমস্যাও অনেক অনেক কমে যাবে।
সাক্ষাৎকারঃ ওসিউর রহমান
No comments:
Post a Comment