বাধ্যতামূলক অবসরকে
নিজেকে ও নিজের সম্পর্কগুলোকে নতুনভাবে ঝালিয়ে নেওয়ার একটা
সুযোগ হিসাবে দেখুন
অ্যাসোসিয়েট
প্রফেসর সাইকিয়াট্রি,
এস এস কে এম
হসপিটাল ও
কনসালট্যান্ট
সাইকিয়াট্রি,
চাইল্ড এন্ড
অ্যাডোলেন্স সাইকিয়াট্রি, পিয়ারলেস হসপিটাল
সারা
পৃথিবী জুড়ে যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেছে, একটাই বাঁচোয়া, এই যুদ্ধ কোন দেশের
সঙ্গে দেশের বা জাতির সঙ্গে জাতির নয়, এক অচেনা শত্রুর সঙ্গে সমগ্র মানবজাতির
লড়াই। কোন এক COVID-19
এসে হঠাৎ করে এ যেন সদা
যুযুধান মানব সমাজকে একত্র করে দিয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, দেশ, আর্থসামাজিক অবস্থা সমস্ত
বিভেদ ভুলে আমরা আবার সবাই মানুষ। আমার পাশের লোকটার ভালো থাকাটাও আমার বা আমার
পরিবারের ভালো থাকার জন্য জরুরি, না হলেই মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়তে পারে
মারণব্যধি- যে আবার দেখে না মানুষের অন্য কোন পরিচয়।
অগত্য আমরা
সবাই ঘরবন্দি- বাধ্যত, না হলে ট্রান্সমিশন চেন থামবে না যে।এতেও হয়তঃ সংক্রমণ হবে।
কিন্তু তা হবে ধীরে ধীরে, আমাদের পরিকাঠামো সেই চাপ সামলে নেবার সুযোগ পাবে। আমাদের বিজ্ঞান সময় পাবে
রোগটিকে ভালো ভাবে বোঝার- তার সঙ্গে লড়াই করার। চীন, কোরিয়া বা সিঙ্গাপুরের মত
আমরাও রুখে দিতেও পারি এই অচেনা শক্রকে। এই ভাইরাস মানুষের দেহের বাইরে খুব বেশী
দিন বাঁচে না। তাই
সামলে রাখো সব মানুষকে। কারো মধ্যে রোগের লক্ষণ দেখা না গেলেও, তার থেকে থেকে ছড়াতে পারে এই মারণ ব্যাধি। তাই
সতর্কতা কাম্য। আমার থেকে পাড়ার লোকের হলে, তা আবার ঘুরে আমার বাড়িতেই ফিরে আসতে
পারে। আমি হয়ত সামলে উঠেছি কিন্তু আমার প্রিয়জনের কাছে তা মারাত্মক হয়ে উঠতে
পারে-তাই সাবধানতা জরুরি, বাড়িতে থাকুন, ভালো থাকুন।
কিন্তু
বাড়িতে থাকলেই তো হল না। আমাদের দৈনন্দিন এতো কাজ! সামলাবে কে! রোজগারের বা কি
হবে! দৈনন্দিন কাজ থেকে ছুটি ১-২ দিন ভালো লাগে কিন্তু তিন সপ্তাহ! কেউ কেউ আবার
বলছে আরও বেশি চলবে এই অবস্থা। বাজারে জিনিস থাকবে তো! যদি অমিল হয় খাদ্যদ্রব্য!
পরিবারের বয়স্ক আত্মীয় থাকেন দূরে একা, যদি কোন শরীর খারাপ হয়! সাহায্যের উপায়
থাকবে তো! সারাদিন বাড়িতে করবই বা কি! Work from home ভালো কিন্তু কতদিন! ব্যবসা
কমে গেলে ছাঁটাই করে দেবে না তো!- ইত্যাদি নানা চিন্তা আমাদের মাথার মধ্যে ভীড় করে
আসে সর্বক্ষণ, স্ট্রেস হরমোনগুলোর আর দোষ কি! তারা মাথার মধ্যে তুর্কি নাচন
শুরু করে। ফলে দুশ্চিন্তা, নিদ্রাহীনতা, হতাশা, রাগ বিরক্তি, ফলতঃ বাড়িতে অশান্তি।
জানেন তো,
সমস্যা আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্যার রূপটা শুধু বদলে যায়।
যে সমস্যা শুধু আমারই সেটা বরং সামলানো কঠিন। যে সমস্যা সবার, তা সামলানোর জন্য
আলোচনার বন্ধু অনেক পাওয়া যায়। আর কে না জানে সমস্যার সমাধানে আলোচনা ও কথাবলা (
sharing ) বা কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপির একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রফেশানালরা
তো আছেনই। প্রথমে আপনার বন্ধুদের সঙ্গেই কথা বলুন! দেখা না হয় করা যাচ্ছে না। ফোন তো আছেই বা Whatsapp
Call, skype এও তো চলতে পারে আড্ডা, দেখবেন অনেকেই এই অবস্থায় নিজেদের মতো
করে গুছিয়ে নিয়েছেন। আপনিও রাস্তা পেতে পারেন। নিদেনপক্ষে নিজের দুঃখ ভাগ করে
নিলেও তা লাঘব হয়। সময় আছে এখন, বহু দিনের না করা ফোনগুলো সেরে ফেলুন না। ভালো
লাগবে দেখবেন।
সমস্যার
সমাধানে দৃষ্টিভঙ্গি ও মানিয়ে নেওয়ার উপায় (coping stategy) গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার
অবস্থানের উপর নির্ভর করে আপনার বর্তমান অবস্থা আপনার কাছে সমস্যা না সুযোগ।
আমরা যদি
ভাবতে থাকি আমরা কি পাচ্ছি না বা রোজকার জীবন থেকে কার্য্যত আমরা বহু দূরে ছিটকে
গেছি। তাহলে চাপ অসহনীয় হয়ে উঠবে।
যাদের
দৈনন্দিন রুটিরুজির সংস্থানের অভাব ঘটছে বরং তাদের কথা ভাবি। আজ সরকার বা সমাজের
উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো, যার যেটুকু সামর্থ্য তাই দিয়ে। অসংগঠিত শ্রমিকদের
রোজগার যাতে বাধাপ্রাপ্ত না হয়. তার দায়ও সমাজকে নিতে হবে। এটা বুঝতে হবে, তাদের
কিছু হলে আমরাও কিন্তু বাঁচবো না। রোগ মানুষ থেকেই মানুষে ছড়ায়। তাই ‘সকলের তরে সকলে
আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’।
কিন্তু
আমাদের সময়টা কাটবে কিভাবে! আমাদের প্রতিদিনের ব্যস্ততার ফাঁকে কতকিছু না করা থেকে
যায় – কোন ফেলে আসা শখ বা ভালোলাগা যেমন- ছবি আঁকা, গান শোনা, কবিতা লেখা, বই
পড়া, সিনেমা দেখা, রান্না করা ইত্যাদি।
রোজের
ব্যস্ততায়, আমাদের নিজেদের প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো হয়ে ওঠে না। স্বামী-স্ত্রী,
সন্তান, সবার সঙ্গে কিছু একান্তে সময় কাটালে, আমাদের প্রত্যেকরই ভালো লাগে,
সম্পর্কগুলো আবার সতেজ হয়, সহজ হয়, নতুন করে বন্ধনগুলো তৈরী হয়।
একটু
শরীরচর্চা করলে এই সময় সুস্থ থাকা সম্ভব এবং এর ফলে সুখী হরমোন বা এন্ডোরফিন
নিঃসৃত হলে মনও সতেজ থাকে।
এক ঝলক
ভাবুন, আমরা যেগুলোকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে ভাবতাম, মনে হতো এগুলো ছাড়া
চলবে না, সেগুলো সত্যই কতটা জরুরি! জীবন তার নিজস্ব ছন্দে বয়ে চলে, আমাদের আকাশ
বাতাস পরিচ্ছন্ন হয়। জীবন সবচেয়ে বড়, তার বাইরে বাকি কোন কিছুই অপরিহার্য্য নয়-
এই বোধটা একসঙ্গে একটা সমাজের মধ্যে তৈরী হওয়ার এর থেকে বড় সুযোগ পাওয়া মুশকিল।
একটা
সমাজকে একযোগে অনেকটা শান্ত ও স্থিতবী করে তুলতে পারে এই বোধটা। প্রতি মুহূর্তে
পাশের লোকটির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না গিয়ে সহযোগিতার মাধ্যমেই যে আরও ভালভাবে
বাঁচা যায়- সেই বোধটাও তৈরী হয়।
ছোটদের
সময়টা সত্যিই খুব কঠিন। সারাদিন বাড়িতে বড়দের সঙ্গে কাটানোটা কষ্টকর বই কি!
আমাদেরও তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর অভ্যাস হারিয়ে যায়- তাই একটু সন্তানদের সাথে
মূল্যবান সময় কাটানোর চেষ্টা করলে সেটা ভালোই লাগবে- মাঝে মাঝে ভিতরের শিশু বা
কিশোরটিকে জাগিয়ে তুলতে দেখবেন ভালোই লাগে। – সন্তানও এক নতুন বাবা মাকে পেতে পারে
- যারা কখনও তাদের মতোই ভাবত। ভবিষ্যতের অনেক সমস্যার পথ আটকাতে পারে এই সুন্দর
সময়গুলো ও তার ফলে তৈরী হওয়া বন্ধন। তবে একই সঙ্গে ইন্টারনেট ও স্কাইপ-এ
শিক্ষাদানের রাস্তাও ধীরে ধীরে তৈরী হবে। প্রয়োজনেই হয় নতুন আবিষ্কার, আর
আবিষ্কারই নতুন বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
তাই হঠাৎ
পাওয়া এই বাধ্যতামূলক অবসরকে একটা সুযোগ হিসাবে দেখুন- নিজেকে ও নিজের
সম্পর্কগুলোকে নতুনভাবে ঝালিয়ে নেওয়ার। নিজের ভালোলাগা গুলোকে আরও একবার ফিরে
দেখার। নিজের সঙ্গে মুখোমুখি বসার সময়ও তো দরকার- ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণের জন্য।
এটাই সেই সময়। কি করতে পারছেন না, সেগুলো নিয়ে দুঃখ না করে, কি করতে পারেন নতুন
ভাবে সেই নিয়ে ভাবুন। কারণ এই গৃহবন্দিত্ব আমাদের ভালোর জন্যই প্রয়োজন- আমাদের
বেঁচে থাকার জন্য, সমাজের সুস্থতার জন্য। শুধু তাই নয়, কোথাও বোধহয় তা পৃথিবীকেও
নতুন করে বাঁচার পথ দেখাতে পারে। ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন, খুশী থাকুন।
No comments:
Post a Comment